দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সে পরিবর্তন গুণগত নাকি উপরিতলে একটা দেখানো-পরিবর্তন সেটা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। জাগো নিউজেই এর আগে লিখেছিলাম যে, দীর্ঘ তিন মাসেরও বেশি সময় লন্ডনে কাটিয়ে বাংলাদেশে ফিরে বেগম জিয়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করে কক্সবাজার গিয়েছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে।
যাত্রাপথে তার গাড়িবহরে হামলা থেকে শুরু করে যে সব কাণ্ড ঘটেছে তা আসলেই এড়ানো যেতো। সেটা সরকারের পক্ষ থেকেই হওয়া উচিত ছিল। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা দেশের ভেতর সফর করবেন তাতে বাধা দেওয়ার যে সংস্কৃতি এতোদিন তৈরি হয়েছিল তা থেকে না বেরুলে এর পরে অন্য কোনো সরকার এর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে পারে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তবে একথাও কেউ কেউ তর্কের খাতিরে বলতে পারেন যে, ক্ষমতাসীন সরকার ও রাষ্ট্রীয় মদদে ঘটা ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার চেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা আর কী হতে পারে? সেক্ষেত্রে বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই বটে কিন্তু একথাও তো সত্য যে, এ ধরনের প্রতিহিংসার রাজনীতি আর কতোদিন চলবে এদেশে? এর থেকেতো মুক্তি প্রয়োজন দেশ ও জাতির, তাই নয় কি?
রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে সরকারের পক্ষ থেকে একটুখানি ছাড় দেওয়ার লক্ষণ দেখা গেলেও (যদিও ছাড় দিয়ে আবার বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে) বিএনপি’র পক্ষ থেকে কোনো প্রশংসাসূচক বাক্য পাওয়া যায়নি কেবল নিন্দা ছাড়া
দীর্ঘকাল পরে ঢাকা শহরে বেগম জিয়া জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। তার জনসভায় লোক সমাগমে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে বিএনপি’র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। টেলিভিশন ও গণমাধ্যমেও আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন জনে বলছে কী অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে তারা জনসভাস্থলে এসে পৌঁছেছেন। তার পরও বিএনপি’র স্মরণকালের রাজনীতিতে এতো বড় জনসমাগম আর হয়নি বলেই বলা যায়।
এই জনসভা একথাও প্রমাণ করে যে, জনসমর্থনে দলটি কারো থেকে পিছিয়ে নেই। একথা দলটি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই সত্য। এদেশে আওয়ামী-বিরোধী যে প্ল্যাটফরমটির নেতৃত্ব বিএনপি দিয়ে আসছে তা কোনো ভাবেই অগ্রাহ্য করার মতো নয়। কিন্তু তারপরও কেন দলটিকে নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র, মাগুরা বা ঢাকা-১০ উপনির্বাচনে বিপুল কারচুপি, ভোটারবিহীন একক নির্বাচন, কোটি কোটি জালভোটার সংযোজন কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করতে হয়ে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা টিকে থাকার জন্য সেটা রাজনীতিতে এক প্রবল বিস্ময়ের ঘটনা। আমি এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যদি বিএনপি নির্বাচনে যেতো তাহলে সে নির্বাচনের ফলাফল অন্যরকম হোতো, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু নির্বাচনে না গিয়ে নির্বাচনকে প্রতিহত করার যে প্রক্রিয়া বিএনপি গ্রহণ করেছিল তা ছিল আত্মঘাতী, আজকে সে কথাও বিএনপি’কে স্বীকার করে নিয়েই রাজনীতি করতে হবে। যদিও ঢাকায় অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য থেকে আমরা এমন কোনো কথাই শুনিনি। বরং তিনি তার বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ‘মানুষ’ বানাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কোনো বিশ্লেষণেই এই ঔদ্ধত্যকে প্রশংসা করা যায় না, যাবে না। কারণ যে ব্যক্তি বা নেতা তার নিজের দলতো দূরের কথা তার নিজের সন্তানকে সঠিক ও প্রশংসনীয় রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারেননি তিনি কী করে আরেকটি রাজনৈতিক দলকে ‘মানুষ’ বানানোর দায়িত্ব নিতে পারেন?
বিএনপি’র জনসমাবেশকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল তা মূলতঃ দু’ধরনের। এক. বিএনপি’র ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীরা এতে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। দুই. সরকারের বিরুদ্ধে এই সমাবেশ আয়োজনে বাধা দেওয়ার অভিযোগ নিঃসন্দেহে সরকারকে জনমানুষের নিন্দার মুখে ফেলেছে, অর্থাৎ সরকার এখানে নাম্বার হারিয়েছে। ফলে এই আয়োজন থেকে বেগম জিয়া কী বলেন বা কী ভাবে তার সমর্থকগোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলেন তার দিকে সকলেরই দৃষ্টি ছিল। এমনকি অনেক সরকারি/বেসরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীও বেগম জিয়ার বক্তব্য শোনার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের সমালোচনা সর্বসিদ্ধ একটি বিষয়। বেগম জিয়া সেটা করতেই পারেন এবং করেছেনও। মানুষের জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তা যদি কোনো সরকার সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় তার সমালোচনা মূলতঃ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোই করে থাকে। কিন্তু সেই সমালোচনা যখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে তখন মানুষ যে দলটি সমালোচনা করছে তার শাসনামলকে স্মরণ করে তুলনামূলক বিশ্লেষণে মেতে ওঠে।
বলাই বাহুল্য যে, বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে তুলনা টানলে কোনোভাবেই, যে কোনো সূচকেই বেগম জিয়ার সরকার শেখ হাসিনার সরকারের তুলনায় পিছিয়ে পড়বেন। সেটা সরকার পরিচালনায় হোক, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হোক কিংবা বিদ্যুৎ বা জ্জ্বালানি সেক্টরের তুলনা হোক। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বিএনপি নেতৃত্ব বা বেগম জিয়া তাদের বক্তৃতায় কখনওই আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের তুলনা টানেন না, কারণ একথা সত্য যে, তারা এক্ষেত্রে কোনো কৃতিত্বই নিতে পারবেন না। সে কারণেই হয়তো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায়ও বেগম জিয়া এই সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা না করে সরকারের রাজনীতির সমালোচনা করেছেন, প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের হয়রানির কথা বলেছেন, যার সঙ্গে অনেকেই হয়তো একমত হবেন। কিন্তু সেসব কথা বলতে গিয়ে বেগম জিয়া যখন ঔদ্ধত্যভরে আওয়ামী লীগকে ‘মানুষ’ বানানোর ঘোষণা দেন তখনই মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে যে, তিনি তো নিজের দলকেই সামলাতে পারেননি, মানুষতো এখনও হাওয়া ভবনের দৌরাত্ম্য ভোলেনি, ভোলেনি দশ ট্রাক অস্ত্র কিংবা বাংলা ভাইয়ের আতঙ্ক। তাহলে তিনি কী ভাবে আরেকটি রাজনৈতিক দলকে ‘মানুষ’ বানাবেন?
বেগম জিয়ার বক্তব্যের সবচেয়ে প্রশংসিত বাক্য ছিল যে, তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। সত্যিই এদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা না থাকলে পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটতো না, ঘটতো না ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা বা আহসান উল্লাহ্ মাস্টার বা শাহ্ এ এস এম কিবরিয়া হত্যার ঘটনা। প্রতিহিংসার রাজনীতি না থাকলে হয়তো এদেশে গুমের রাজনীতিও হতো না। তার মানে এই ভয়ংকর রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতি টানতে হবে এবং সেটা সকল পক্ষকেই। বেগম জিয়া তাই এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কিন্তু বেগম জিয়া যখন তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে সেটা আদালতেই হোক আর জনসভাতেই হোক একথা বার বার বলেন যে, তিনি শেখ হাসিনাকে ‘ক্ষমা করে দিলেন’ তখন তার এই প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি মানুষের কাছে হাস্যকর হয়ে যায় কারণ শেখ হাসিনাকে তিনি ক্ষমা করতে চান কোন্ কারণে?
শেখ হাসিনার অপরাধটিই বা কি? আগে বেগম জিয়াকে স্পষ্ট করে শেখ হাসিনার অপরাধ সম্পর্কে জনগণকে জানাতে হবে এবং তারপর জনগণ যদি মনে করে যে শেখ হাসিনা সত্যিই কোনো অপরাধ করেছে তাহলে প্রথমে প্রশ্ন আসবে জনগণ শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করবে কিনা? যদি জনগণ ক্ষমা না করে তাহলে বেগম জিয়ার কোনো এখতিয়ার নেই শেখ হাসিনাকে ক্ষমা করার। তার মানে বেগম জিয়ার এই বক্তব্য চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ এক ভাষণ যা আসলে প্রমাণ করে যে, বিএনপি তার অতীত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বা চায়ও না। মুখে বললেও কার্যতঃ দলটি ভবিষ্যতে ক্ষমতা পেলে এদেশের বহু মৌলিক চরিত্র বদলে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না যেমনটি করেছিল দলটির প্রতিষ্ঠাতা সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান।
শুরুতেই বলেছি যে, এদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন একটি সর্বজনকাম্য বিষয়। কিন্তু সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সর্বজনগ্রাহ্য অবস্থানে এসে দাঁড়িয়ে একত্রে তা কার্যে পরিণত করতে হবে। কিন্তু গত কয়েকদিনের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে সরকারের পক্ষ থেকে একটুখানি ছাড় দেওয়ার লক্ষণ দেখা গেলেও (যদিও ছাড় দিয়ে আবার বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে) বিএনপি’র পক্ষ থেকে কোনো প্রশংসাসূচক বাক্য পাওয়া যায়নি কেবল নিন্দা ছাড়া। ফলে ধারণা করাই যায় যে, এরপর নতুন কোনো ছাড় দিতে সরকারের পক্ষ থেকেও হয়তো গড়িমসি হবে, যদিও দেশের একটি রাজনৈতিক দল তাদের স্বাভাবিক রাজনীতি করলে তাতে ছাড় বা বাধা দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতিই যে আমাদের এখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটাও আমাদের মানতে হবে।
তবে এতোকিছুর পরেও একথা বলতেই হবে যে, বিএনপি’র সমাবেশ, বেগম জিয়ার বক্তব্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরির্দশন এবং নির্বাচন বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ রাজনীতিতে একটা গতির সৃষ্টি করেছে কোনো সন্দেহ নেই। এর আগে আমরা দেখেছি যে, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস এলেই এদেশে জ্বালাও-পোড়াও আর হরতালের রাজনীতি শুরু হতো। বেশ কয়েকবছর তার ব্যতিক্রম মানুষকে রাজনীতিতে সত্যিই আশাবাদী করে তুলেছে বলে মনে হয়, অর্থাৎ রাজনীতিতে নিশ্চিত ভাবেই নভেম্বর-ডিসেম্বর সংস্কৃতির একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। সরকারের উচিত হবে এই গতির বিপরীতে নিজেদের গতিও ত্বরান্বিত করা যাতে দেশের মানুষ আর সন্দেহে না ভোগে যে, নির্বাচন হবে তো? এখন দু’পক্ষেরই দায়িত্ব দেশের মানুষকে নির্বাচনমুখী করা, সকল ভয়-ভীতির উর্ধ্বে থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগে আশাবাদী করে তোলা। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে সবার আগে সেটাই প্রয়োজন।