পশ্চিমা রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই প্রশংসিত, অন্তত দেশের মানুষের কাছে জবাদিহিতার প্রশ্নে শতভাগ স্পষ্ট থাকার চেষ্টা করেন এদেশের রাজনীতিবিদেরা। কোন রিউমার কিংবা নেতিবাচক প্রচারণায় রাষ্ট্রের কিংবা পার্টির দুর্নাম এসে যায়, এরকম জায়গায় রাজনীতির নীতি নির্ধারকেরা খুবই স্পর্শকাতর। পার্টি তখন ঐ নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। এরকম পরিস্থিতিতে এসব নেতাদের টিস্যু পেপারের মতো উড়িয়ে দিতেও পিছপা হয় না দল। এবং এটা যত গুরুত্বপূর্ণ পদ হোক কিংবা ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হোন না কেন।
২) কিন্তু এবারের কেলেঙ্কারি’র ডাল-পালা এতটাই বিস্তৃত যে, ব্রিটিশ রাজনীতিতে যেন ‘চোর ধরতে গা উজাড়ে’র মতো অবস্থা। রীতিমত একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে ব্রিটেনের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে, যা সামাজিকভাবে ব্যাপক ধাক্কা দিচ্ছে। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের জীবন-যৌবন-বার্ধক্য এতে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তাদের অনৈতিক আচরণ গোটা রাজনীতির জন্যে একটা দুঃসংবাদ। তবে সুসংবাদ হলো ব্রিটিশ ব্যবস্থায় নারীরা আরও বেশি দৃঢ় হচ্ছে, কঠোর হচ্ছে, বিজয়ী হচ্ছে এবং পুরুষ রাজনীতিবিদেরা লজ্জা নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে প্রস্তুত হচ্ছেন। আর যার প্রথম বিদায়ী নেতা মাইকেল ফ্যালন।
‘অন্তত ৪০ জন মন্ত্রী-এমপি’র বিরুদ্ধে উঠেছে অভিযোগ। অবাধ যৌনাচারে পতিত নেতাদের নিয়ে মিডিয়া আর ব্রিটেনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন উত্তপ্ত ।’
টোরি সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী তিনি। একজন সাংবাদিককে যৌন সুড়সুড়ি দেয়ার দায় নিয়েই ডিফেন্স সেক্রেটারি ফ্যালনকে বেরিয়ে যেতে হলো সরকারের উচ্চাসন থেকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো ১৫ বছর আগে একজন নারী সাংবাদিকের হাঁটুতে বার বার হাত দিয়েছেন তিনি। বার বার উদোম হাঁটুতে হাতের স্পর্শ পাওয়া ঐ সাংবাদিক শেষ পর্যন্ত অবশ্য বলেছিলেন যে, ‘আমাকে চড় মারতে বাধ্য করবেন না’। ফ্যালনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এই অভিযোগ আর তার পার্টির জন্যে যাতে বিষফোড়া না হয় সেজন্যে তিনি পদত্যাগ করলেন। কিন্তু বিষয়টা এখানেই শেষ হয় নি, অপরাধ স্বীকার করে গত বুধবার অর্থাৎ ১ নভেম্বর ফ্যালনের পদত্যাগের পর থেকে মিডিয়া পাড়া উষ্ণ হয়ে উঠে। একে একে আসতে থাকে নতুন কেলেঙ্কারির খবর। ক্যাবিনেট মেম্বার ডেমিন গ্রিন এমনকি থেরেসা মে’র ডেপুটি আছেন কেলেঙ্কারি তদন্তের তালিকায়।
অন্তত ৪০ জন মন্ত্রী-এমপি’র বিরুদ্ধে উঠেছে অভিযোগ। অবাধ যৌনাচারে পতিত নেতাদের নিয়ে মিডিয়া আর ব্রিটেনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন উত্তপ্ত । তটস্থ মন্ত্রী কিংবা সব দলের নেতা-নেত্রীরা। কারণ প্রধান দুটো দলেরই নেতা-নেত্রীরা এতে অভিযুক্ত হচ্ছেন। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, অভিযুক্ত এসমস্ত মন্ত্রী-এমপিদের অধিকাংশই কনজারভেটিভ পার্টির। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিব্রতকর অবস্থায় গোটা পার্টি। প্রধানমন্ত্রী ও পার্টির লিডার থেরেসা মে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, এবং নেতাদের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
নেতা-নেত্রী কিংবা অভিজাতদের মাঝে ব্রিটিশ মূল্যবোধের স্থানটিতে সংঘাত চলছে তা থেরেসা মে তার এক বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছেন। সেজন্যেই তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে পারস্পরিক সম্মানের সংস্কৃতি (কালচার অব রেসপেক্ট) গড়ে তোলার উপর সাংসদদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর এ ইস্যু নিয়ে তাই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসবেন থেরেসা মে। ব্রিটিশ রাজনীতির একটা স্পর্শকাতর সময়ে বিরোধী দলগুলোও তাই থেরেসা মে কে সমর্থন জানাচ্ছে। সংকটময় এই বৈঠকে তাই যোগ দেবেন মে’র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি করবিনও। ব্রিটিশ রাজনীতিতে এতবড় যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছে বলে কোন প্রমাণ নেই। ঘঠলেও তা আসে নি জনসমক্ষে। এই প্রথম এলো ব্রিটেনের জনগণের সম্মুখে।
৩) ব্রিটেনের সংস্কৃতিতে এরকম ঘটনা হয়ত নতুন নয়। সেলিব্রেটিরা বিভিন্ন সময় তাদের খ্যাতি দিয়ে বিভিন্ন সময় যৌনাচার চালিয়েছেন। কিন্তু ভয়ে-লজ্জায় অনেক অন্ধকারই আলোর মুখ দেখে নি। জিমি সাভিল ছিলেন ব্রিটেনের মিডিয়াপাড়ার এক বিখ্যাত মানুষ। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান রেডিও-টিভি প্রেজেন্টার। তার মুত্যু হয় ২০১১ সালে। তার দু’বছর পর এক বৃদ্ধা নারী প্রথম এই খ্যাতিমানের প্রতি অভিযোগের তীর ছুঁড়ে মারেন ২০১৩ সালে। পরবর্তীতে একে একে আসতে থাকে শতাধিক অভিযোগ। সেসময়ে গণমাধ্যমের সংখ্যা ছিলো সীমিত। সেই সীমিত গণমাধ্যমে তিনি ছিলেন জনপ্রীয়তার এক শীর্ষস্থানীয় তারকা।
অর্ধ শতাব্দীকাল তিনি ছিলেন কিশোর-যুবক-যুবতীদের নায়ক কিংবা সেলিব্রিটি। তার হাসিমাখা মুখ ছিলো তখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রধান চমক। অথচ তার হাসির পেছনে তিনি কত কদর্য আর নৃশংস ছিলেন তা বেরিয়ে আসে তার মৃত্যুর পর। একে একে বেরিয়ে আসে অনেক নির্মম সত্যগুলো, অকাট্য প্রমাণসহ। সহ প্রেজেন্টার থেকে শুরু করে তার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ৯ বছরের শিশু-কিশোরীদের সাথে জিমি পিড়ন করেছেন, যৌনাচার চালিয়েছেন। এমনকি মৃত মানুষের সাথে সাভিলের যৌনাচারের বিভীষিকাময় বিকৃতির ঘটনাগুলো আমরা হাল আমলে শোনলাম।
ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। কদর্যতা কেউ না কেউ জনসমক্ষে নিয়ে আসে। আর তাইতো আগামী পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় পাতায় জিমি সাভিল একজন পারভার্টেড, পিডোফাইল কিংবা সেক্স-ক্রিমিনাল । জিমি’র দ্বারা নিগৃহীত মহিলাদের এগিয়ে আসাটা ছিলো ব্রিটেনের ইতিহাসে এক সাহসী পদক্ষেপ। এর মানে এটা নয় যে, ব্রিটেনে এরকম কোন অপরাধের কোন বিচার হচ্ছে না। তা নয় অবশ্যই। যারাই বেরিয়ে আসছে, তাদের বিচারের জন্যে নিভৃতে কাঁদতে হয় না।
৪) সময়টা এভাবেই পাল্টাচ্ছে। নারীরা বেরিয়ে আসছে। কৈশোরে কিংবা যৌবনে যৌন পীড়ন পৃথিবীর সব জায়গায়ই কোন না কোনভাবে সংঘটিত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক জুনিয়রদের যৌন নিপীড়নটা করা হয় বিভিন্নভাবে। শিক্ষানবীশ হিসেবে কিংবা নতুনদের উচ্চাকাঙ্খার সুযোগকে এরা কাজে লাগায়। এদের ক্যারিয়ারকে পোক্ত করার নিশ্চয়তা দিয়ে ঐসব কথিত নেতারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে যৌন নিপীড়নের মাধ্যমে। একদিকে লজ্জা, অন্যদিকে ক্যারিয়ার ঐ দোদুল্যমানতার মধ্যে দিয়ে এরা পার করে বছরের পর বছর। কিন্তু যে ক্ষত নিপীড়িতদের হৃদয়ে লেগে থাকে সেই ক্ষত-চিহ্ন এদের যায় না, হয়ত সময়ের অপেক্ষা করে তারা। কিন্তু সুযোগ সবসময়র ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেও থাকে না।
ব্রিটিশ রাজনীতিতে এবার সে সুযোগ এসেছে। তাইতো এমনকি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুপা হক পর্যন্ত অত্যন্ত সাহসের সাথে বলতে পেরেছেন, তিনিও যৌন নিপীড়নের শিকার। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি সেসময়ের-এসময়ের একজন খ্যাতিমান মানুষের হাতের পীড়ন থেকে রক্ষা করতে পারেন নি নিজেকে। কিন্তু এবার যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্ক্যান্ডাল বেরিয়ে আসছে একে একে, ঠিক তখনই তিনিও বেরিয়ে এলেন। এখনও নাম উচ্চারণ করেন নি। হয়ত তর তর কাঁপাছেন সেই মানুষটি এখন।
ব্রিটিশ রাজনীতির এই কাঁপন এখন গড়াচ্ছে মৃত্যুর যন্ত্রণায়। ওয়েলস এর সাবেক মিনিস্টার কার্ল সারজেন্ট এর বিরুদ্ধে অনৈতিক মহিলা পীড়নের অভিযোগ উঠেছে, এবং এটা তদন্ত চলছে। কিন্তু তদন্ত চলাকালীন সময়েই গত মঙ্গলবার কার্লের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে ওয়েলস এর পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
৫) খুব স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তি চলছে গোটা ব্রিটেনের রাজনীতির আকাশে। কনজারভেটিভ পার্টি এমনিতেই ব্রেক্সিট নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। ইউরোপের সাথে দেন-দরবার, দলের অভ্যন্তরে থেরেসা মে’র সংগ্রাম, লেবার পার্টি থেকে ব্রেক্সিটের বিরোধিতা প্রভৃতি নিয়ে থেরেসা মে কঠিন সময় কাটাচ্ছেন। এসময় যৌন কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত মন্ত্রী-এমপিদের অধিকাংশই তার দলের। দেশ আর জাতির কাছে মে’র দল-সরকার এখন প্রশ্নের মুখোমুখি। কি করবেন থেরেসা মে। বিরোধী দলের নেতাসহ অনুষ্ঠিতব্য রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে কি আসছে ঐ নেতাদের ভাগ্যে। রাজনীতি থেকে নেতারা বিদায় নেবেন না- কি সরকার হিসেবে দুর্বল হয়ে পড়বে ব্রিটেনের বর্তমান থেরেসা মে’র নেতৃত্ব। না-কি আগামীর নির্বাচনে টোরীর প্রস্থান হচ্ছে নিশ্চিত। জেরেমি করবিনই কি আগামীর ব্রিটেনের কান্ডারি , সে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে এখন ব্রিটেনের রাজনীতির আকাশে।